ফেব্রুয়ারি ১২
দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা সফর করে,ইমিগ্রেশনের ঘেরাটোপ পেরিয়ে, যখন মার্কোপোলো এয়ারপোর্টে পা রাখলাম ঘড়িতে তখন ভেনিসের সময় হিসাবে ১:৩০ টা বাজে।মাসটা ফেব্রুয়ারি।শীত চলে যাবার প্রাক্কালে শেষ কামড় বসাচ্ছে।ফ্লাইট থেকে নামার আগেই লেদার জ্যাকেটটা জড়িয়ে নিয়েছিলাম।এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোতেই একটা জোলো ঠান্ডা হাওয়া আমাদের কাবু করে ফেললো।এখন আমাদের গন্তব্য সান মার্কো বা সেন্ট মার্কাস স্কোয়ার।বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে আমরা দুটি প্রানী ওয়াটার ট্যাক্সি বা স্থানীয় ভাষায় "আলিলাগুয়ানা" র দীর্ঘ লাইনে পা রাখলাম।বলে রাখা ভালো নামটা কিম্ভুতুরে হলেও এই আলিলাগুয়ানা অনেকটাই আমাদের দেশের লঞ্চ বা স্টীমারের মতো।উষ্ণতা তখন থার্মোমিটারে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস,কিন্তু সমুদ্রের হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ায় মোবাইল স্ক্রিনে রিয়েল ফিল দেখাচ্ছে ( -২ )ডিগ্রি।দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে চেপে পড়লাম "আলিলাগুয়ানা" তে মূল ভূখণ্ডের উদ্দেশ্যে। স্বপ্নের ভেনিস,সুনীল গাঙ্গুলি ইতালি এলে অবশ্যই আরেকবার 'ছবির দেশে,কবিতার দেশে'লিখে ফেলতেন।পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলির অন্যতম ভেনিস বা ভেনেজিয়া।ইউনেস্কর হেরিটেজ সাইটে ভেনিসের উল্লেখ অন্যতম।লাগুনা ভেনেশিয়া বা ভেনেশিয়ান উপহ্রদ ঘিরে রেখেছে শহরটাকে।গোটা শহর জুড়ে কোন স্থায়ী রাস্তা নাই,প্রায় ৩৫০ র উপর সেতু জুড়ে রেখেছে পুরো শহরটাকে।সমুদ্রের জল শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ক্যানেল হয়ে।মানে,তুমি সকালে প্রাতরাশ করতে করতে দেখলে,তোমার জানালার গা ঘেঁষে একটা নদী বয়ে চলেছে,তাতে সুপুরুষ মাঝি নৌকার দাঁড় টানছে গান গাইতে গাইতে,কেমন স্বপ্নের মতো লাগছেনা? ভেনিস এমনই একটা স্বপ্নের দেশ। সানমার্কো স্টপেজে যখন নামলাম,পশ্চিম আকাশ তখন মুখ ভারী করেছে।ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আমাদের স্বাগত জানালো ভেনিস।ছোট থেকে বই পড়ে ছবি দেখে ভেনিসকে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম,শহরটা ঠিক যেন তেমন নয়।এই শহরের কারো কোনো তাড়া নেই,কাউকে অফিস ছুটতে হচ্ছেনা,কারো টিউশনে দেরী হচ্ছেনা,সবার হাতে অঢেল সময় এদেশে।এ এক অন্যদেশ,এ এক মায়ারাজ্য।চারদিকে বুঝি রূপকথার চরিত্ররা ঘুরছে।সম্বিত ফিরল যখন,তখন আমি ভিজে চুপচুপে।শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি।সৌখিন জামাকাপড়ে ট্রলিব্যাগ এমন ভারী যে টানতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল।কাকভেজা ভিজে যখন হোটেল 'টরিনো ভেনিস'এর দরজায় কড়া নাড়লাম,তখন ভেনিসের রোম্যান্স আমার ঘাড় থেকে নেমে,জেটল্যাগের ক্লান্তি এসে ভিড় করেছে।রিসেপশনের ভদ্রলোককে দেবদূত মনে হলো,আহা কি রূপকান্তি।ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে আমাদের হোটেলের নিয়মাবলী বুঝিয়ে দিলেন।হোটেল কামরার উষ্ণবাষ্পে খানিক আরাম করে,গরম বাথটাবে গা ডুবিয়ে সব ক্লান্তি উড়ে গেলো। বিকেল পাঁচটা তখন,বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে।যথাসম্ভব শীতের পোষাক জড়িয়ে,ছাতা হাতে বেড়িয়ে পড়লাম।শহর জুড়ে তখন সে এক বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন চলছে ।এই দিনে কি ঘরে বসে থাকা যায়।পৃথিবীবিখ্যাত উৎসব ভেনিসের 'মাস্ক ফেস্টিভ্যাল' বা মুখোশ উৎসব।গোটাশহর তখন হাজার হাজার ক্যানোপিতে উজ্জ্বল।মুখোশে মুখ ঢেকে নেমে আসছে স্বর্গের দেবদেবীরা।ভাষায় প্রকাশ করা যায়না এমন অবাক করা বেশভূষা;সৌন্দর্য। নিজেকে চিমটি কেটে দেখলাম,নাহ্ স্বপ্ন দেখছিনা।হাজার হাজার ক্যামেরার ঝলকানিতে তখন দৃশ্যবন্দী হচ্ছে মুহূর্তগুলো ক্ষনে ক্ষনে। কে আমি,কোথায় এই দেশ,এইবুঝি স্বর্গ।কোথায় সেই গ্রামেগঞ্জের আমি,কোথায় এই মায়াবী শহর।যতরাত বাড়ছে ,শহরের রূপ তত খোলস ছাড়ছে।তুমুল বৃষ্টি, ভেনিসের স্যাঁতসেঁতে হাড়কাপাঁনো ঠাণ্ডা,১৪ ঘন্টা বিমানের ক্লান্তি সব মিথ্যা,খালি এই শহরটা,এই সময়টা সত্যি।দলে দলে তখন শহরের গলিগালা,আনাচ কানাচ থেকে শয়ে শয়ে মানুষ এসে মিশছে সেন্ট মার্কস্ স্কোয়ারে।বিভেদ নাই,দ্বন্দ্ব নাই,খালি আলোর উৎসবে মাতোয়ারা হবে বলে,সেদিন হাতে হাত মিলিয়ে নিয়েছিলো সবাই।মুগ্ধ চোখে শহরের সব রস,সব সৌন্দর্য শুষে নিচ্ছিলাম আমি। হোটেলে যখন পৌঁছালাম,রাত তখন ১০টা,ঘোর কাটেনি তখনও।সেদিন যা দেখেছিলাম,এমনটা আর কখনও ঘটেনি,কখনও দেখিনি।ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছিলো তখন।একপেট বিস্বাদ ইতালিয়ান পাস্তা খেয়ে বিছানাতে দেহ রাখলাম। ঘুম ভাঙলো তখন সকাল সাতটা।মনে হলো কাল রাতে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম।বলাবাহুল্য ইতালিতে কাটানো ঐ নয়দিন আজও আমার স্বপ্নই মনে হয়।
ইতালি ভ্রমণ-১
ফেব্রুয়ারি ১২
দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা সফর করে,ইমিগ্রেশনের ঘেরাটোপ পেরিয়ে, যখন মার্কোপোলো এয়ারপোর্টে পা রাখলাম ঘড়িতে তখন ভেনিসের সময় হিসাবে ১:৩০ টা বাজে।মাসটা ফেব্রুয়ারি।শীত চলে যাবার প্রাক্কালে শেষ কামড় বসাচ্ছে।ফ্লাইট থেকে নামার আগেই লেদার জ্যাকেটটা জড়িয়ে নিয়েছিলাম।এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোতেই একটা জোলো ঠান্ডা হাওয়া আমাদের কাবু করে ফেললো।এখন আমাদের গন্তব্য সান মার্কো বা সেন্ট মার্কাস স্কোয়ার।বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে আমরা দুটি প্রানী ওয়াটার ট্যাক্সি বা স্থানীয় ভাষায় "আলিলাগুয়ানা" র দীর্ঘ লাইনে পা রাখলাম।বলে রাখা ভালো নামটা কিম্ভুতুরে হলেও এই আলিলাগুয়ানা অনেকটাই আমাদের দেশের লঞ্চ বা স্টীমারের মতো।উষ্ণতা তখন থার্মোমিটারে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস,কিন্তু সমুদ্রের হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ায় মোবাইল স্ক্রিনে রিয়েল ফিল দেখাচ্ছে ( -২ )ডিগ্রি।দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে চেপে পড়লাম "আলিলাগুয়ানা" তে মূল ভূখণ্ডের উদ্দেশ্যে। স্বপ্নের ভেনিস,সুনীল গাঙ্গুলি ইতালি এলে অবশ্যই আরেকবার 'ছবির দেশে,কবিতার দেশে'লিখে ফেলতেন।পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলির অন্যতম ভেনিস বা ভেনেজিয়া।ইউনেস্কর হেরিটেজ সাইটে ভেনিসের উল্লেখ অন্যতম।লাগুনা ভেনেশিয়া বা ভেনেশিয়ান উপহ্রদ ঘিরে রেখেছে শহরটাকে।গোটা শহর জুড়ে কোন স্থায়ী রাস্তা নাই,প্রায় ৩৫০ র উপর সেতু জুড়ে রেখেছে পুরো শহরটাকে।সমুদ্রের জল শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ক্যানেল হয়ে।মানে,তুমি সকালে প্রাতরাশ করতে করতে দেখলে,তোমার জানালার গা ঘেঁষে একটা নদী বয়ে চলেছে,তাতে সুপুরুষ মাঝি নৌকার দাঁড় টানছে গান গাইতে গাইতে,কেমন স্বপ্নের মতো লাগছেনা? ভেনিস এমনই একটা স্বপ্নের দেশ। সানমার্কো স্টপেজে যখন নামলাম,পশ্চিম আকাশ তখন মুখ ভারী করেছে।ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আমাদের স্বাগত জানালো ভেনিস।ছোট থেকে বই পড়ে ছবি দেখে ভেনিসকে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম,শহরটা ঠিক যেন তেমন নয়।এই শহরের কারো কোনো তাড়া নেই,কাউকে অফিস ছুটতে হচ্ছেনা,কারো টিউশনে দেরী হচ্ছেনা,সবার হাতে অঢেল সময় এদেশে।এ এক অন্যদেশ,এ এক মায়ারাজ্য।চারদিকে বুঝি রূপকথার চরিত্ররা ঘুরছে।সম্বিত ফিরল যখন,তখন আমি ভিজে চুপচুপে।শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি।সৌখিন জামাকাপড়ে ট্রলিব্যাগ এমন ভারী যে টানতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল।কাকভেজা ভিজে যখন হোটেল 'টরিনো ভেনিস'এর দরজায় কড়া নাড়লাম,তখন ভেনিসের রোম্যান্স আমার ঘাড় থেকে নেমে,জেটল্যাগের ক্লান্তি এসে ভিড় করেছে।রিসেপশনের ভদ্রলোককে দেবদূত মনে হলো,আহা কি রূপকান্তি।ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে আমাদের হোটেলের নিয়মাবলী বুঝিয়ে দিলেন।হোটেল কামরার উষ্ণবাষ্পে খানিক আরাম করে,গরম বাথটাবে গা ডুবিয়ে সব ক্লান্তি উড়ে গেলো। বিকেল পাঁচটা তখন,বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে।যথাসম্ভব শীতের পোষাক জড়িয়ে,ছাতা হাতে বেড়িয়ে পড়লাম।শহর জুড়ে তখন সে এক বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন চলছে ।এই দিনে কি ঘরে বসে থাকা যায়।পৃথিবীবিখ্যাত উৎসব ভেনিসের 'মাস্ক ফেস্টিভ্যাল' বা মুখোশ উৎসব।গোটাশহর তখন হাজার হাজার ক্যানোপিতে উজ্জ্বল।মুখোশে মুখ ঢেকে নেমে আসছে স্বর্গের দেবদেবীরা।ভাষায় প্রকাশ করা যায়না এমন অবাক করা বেশভূষা;সৌন্দর্য। নিজেকে চিমটি কেটে দেখলাম,নাহ্ স্বপ্ন দেখছিনা।হাজার হাজার ক্যামেরার ঝলকানিতে তখন দৃশ্যবন্দী হচ্ছে মুহূর্তগুলো ক্ষনে ক্ষনে। কে আমি,কোথায় এই দেশ,এইবুঝি স্বর্গ।কোথায় সেই গ্রামেগঞ্জের আমি,কোথায় এই মায়াবী শহর।যতরাত বাড়ছে ,শহরের রূপ তত খোলস ছাড়ছে।তুমুল বৃষ্টি, ভেনিসের স্যাঁতসেঁতে হাড়কাপাঁনো ঠাণ্ডা,১৪ ঘন্টা বিমানের ক্লান্তি সব মিথ্যা,খালি এই শহরটা,এই সময়টা সত্যি।দলে দলে তখন শহরের গলিগালা,আনাচ কানাচ থেকে শয়ে শয়ে মানুষ এসে মিশছে সেন্ট মার্কস্ স্কোয়ারে।বিভেদ নাই,দ্বন্দ্ব নাই,খালি আলোর উৎসবে মাতোয়ারা হবে বলে,সেদিন হাতে হাত মিলিয়ে নিয়েছিলো সবাই।মুগ্ধ চোখে শহরের সব রস,সব সৌন্দর্য শুষে নিচ্ছিলাম আমি। হোটেলে যখন পৌঁছালাম,রাত তখন ১০টা,ঘোর কাটেনি তখনও।সেদিন যা দেখেছিলাম,এমনটা আর কখনও ঘটেনি,কখনও দেখিনি।ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছিলো তখন।একপেট বিস্বাদ ইতালিয়ান পাস্তা খেয়ে বিছানাতে দেহ রাখলাম। ঘুম ভাঙলো তখন সকাল সাতটা।মনে হলো কাল রাতে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম।বলাবাহুল্য ইতালিতে কাটানো ঐ নয়দিন আজও আমার স্বপ্নই মনে হয়।
Related Articles