878
Atrayee Bhowmick

ইতালি ভ্রমণ-২

 ১৩ই ফেব্রুয়ারি,সকাল ৯টা

প্রাতরাশ সেরে শহর পরিদর্শনে বেরোলাম।আজ মুখোশ উৎসবের অন্তিম ও মুখ্য দিন।শহরে ভীষন ভিড়,সেন্ট মার্কস চত্বর থিকথিক করছে পর্যটক ও মুখোশধারীদের ভিড়ে।শিল্প-ভাস্কর্য যে কোন চরম সীমাতে পৌছাতে পারে তা এই শহরে না এলে জানতে পারতাম না।শহরের পরতে পরতে সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।চিত্রশিল্পীরা সমুদ্রের ধারে,ব্রিজের পাশে পাশে বসে ছবি আঁকছে।বিক্রি হলো কি হলো না,কিছুই এসে গেলো না,ভালো ছবিতো আঁকা হলো।আমার মনে হয় সব ইতালীয়দের মধ্যেই একটা স্বভাব শিল্পী আছে।ওই যে আগেই বলেছি এই শহরে কারো কোনো তাড়া নেই,কেমন গান গেয়ে,ছবি এঁকে,গল্প করে সবাই কাটিয়ে দেয়।ধনীদেশের বুঝি এমন আভিজাত্য মানায়।আমার দেশ, খিদের দেশ।এখানে অতিবড় শিল্পীকেও স্যুট,বুট টাই পড়ে অফিস যেতে হয়।সমাজের সব প্রত্যাশা,ইঁদুর দৌড়ের সিঁড়ি আর এই বেকারেত্বর জ্বালা সব তোলা থাক আমাদের জন্য।সহস্র মাইল দুরের ওই ওরা,গান গাক,ছবি আকুঁক,ফুল ফোটাক। যাই হোক কাব্য করে লাভ নাই।গল্পতে ফেরা যাক।সেদিন আমাদের হাতে সময় কম ছিল,তাই এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত কিছু ছবি তুললাম,বাড়ির লোকজনের জন্য ছোটখাটো কিছু শৌখিন উপহার নিলাম।শহরের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হচ্ছে এই সেন্ট মার্কস্ চত্বর,যাকে 'হার্ট অফ্ ভেনিস' ও বলা হয়ে থাকে।যার পূর্ব দিক ঘিরে রেখেছে সেন্ট মার্কসের চার্চ বা সেন্ট মার্কস্ ব্যাসিলিকা,তার গা ঘেঁষে রয়েছে ইতালির বিখ্যাত বেল্ টাওয়ার।টাওয়ার ছুঁয়ে রাস্তা চলে গেছে রিয়াল্টোর দিকে,যেখানে পৃথিবীবিখ্যাত সব ফ্যাশন ব্র্যান্ডের মার্কেট রয়েছে,যাদের অর্ধেক নাম সঠিক উচ্চারণ করতে দাঁতের বিশেষ জোর থাকা দরকার।স্কোয়ারের দক্ষিণ-পূর্ব দিক বরাবর সোজা হাঁটলে গ্র্যান্ডক্যানেলের তীরে পৌঁছে যাওয়া যায়।বহু নৌকা,ওয়াটার ট্যাক্সি,গন্ডোলা বাঁধা থাকে এখানে।ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে জলের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় ।সামুদ্রিক পাখির আসা যাওয়া,দিগন্ত ঘেঁষে সূর্যাস্ত হওয়া,দড়ির জালে বাঁধা ডিঙি নৌকা বা স্থানীয় ভাষায় গন্ডোলার ওঠা নামা দেখা যায়।ক্যানেল থেকে নাক বরাবর সোজা স্কোয়ারের দিকে গেলে ডানহাতে পড়বে বিশ্ববিখ্যাত ডজের প্যালেস।আমাদের পরবর্তী গন্তব্য এই প্যালেস। রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সময় ইতালিতে যে শৈল্পিক বিপ্লবের সূচনা হয় তার অনেক নিদর্শন এই প্রাসাদে আছে।প্রদর্শনীর সময় সকাল ৮:৩০ টা থেকে বিকাল ৫:৩০ টা।টিকিটের দাম পড়ে প্রায় ১৫-২০ ইউরো।ডজ্ বা ডশ্ ছিলেন ভেনেশিয়ান রিপাবলিকের শাসনকর্তা,তার অধীনে মন্ত্রিসভাও থাকতো।বর্তমানে আমরা যে নতুন প্রাসাদ দেখতে পাই তা নির্মাণ শুরু হয় ডজ্ সেবাস্তিয়ানো জিয়ানির সময়ে।১৪৮৩ র অগ্নিকাণ্ডে প্রাসাদের অনেকংশ ধ্বংস হয়ে যায়।প্রাসাদের পুনর্নির্মাণ শুরু হয় এবং ক্যানেলের তীর অবধি তার প্রসার হয়।১৫৪৭ এ ফের এক অগ্নিকাণ্ডে প্রাসাদের বহু দুর্মূল্য তৈলচিত্র আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়,যারমধ্যে বেলিনী,টাইটিয়ান ও কারপাচ্চিয়োর মতো বিখ্যাত শিল্পীর চিত্রকলাও ছিলো। প্রাসাদে প্রবেশ করার মূল ফটকের নাম 'পোর্টা ডেল ফ্রামেন্তো'।পর্যটক মূলত এই পথেই প্রবেশ করে থাকে প্যালেসের বিখ্যাত প্রাসাদ প্রাঙ্গন বা কোর্টইয়ার্ডে।এই প্রাঙ্গণের গা ছুঁয়ে রয়েছে সেন্ট মার্কস্ ব্যাসিলিকা।প্রবেশ করেই ডানদিকে রয়েছে 'রেনেসাঁ উইং' এবং বাঁদিকে 'পিয়াজেট্টা উইং'।পিয়াজেট্টা উইং এ ঢোকার মুখে রয়েছে জাইয়েন্টস্ স্টেয়ারকেস বা দৈত্যাকৃতি সিঁড়ি।এটি প্রাসাদের প্রাচীন অংশ।এই প্রবেশদ্বার বহুকাল ধরে রক্ষা করে আসছেন রোমান যুদ্ধ দেবতা মার্স এবং সমুদ্রের রক্ষাকর্তা নেপচুন।রোমান উপকথার এই দুই দেবতার দৈত্যাকৃতি মূর্তির জন্যই এই প্রবেশদ্বারের এমন নাম।এই সিঁড়ির উপরাংশে,শেষপ্রান্তে সেযুগে নবনির্বাচিত শাসকের অভিষেক হতো।শোনা যায় ডজ্ মারিনো ফালিয়েরো কে তার পাপের শাস্তি স্বরূপ মুণ্ডচ্ছেদ ও করা হয়েছিল এইখানেই। আমরা প্রাসাদে প্রবেশ করলাম রেনেসাঁ উইং দিয়ে,যা গোল্ডেন স্টেয়ারকেস বা স্বর্ণখচিত সিঁড়ি হয়ে প্যালেসের মূলভাগে পৌঁছে দেয়।এই প্রবেশদ্বার রক্ষা করছেন সর্বশক্তিমান হারকিউলিস এবং পৃথিবী কাঁধে অ্যটলাস।১৩০ টি সিঁড়ির ধাপ উঠতে উঠতে সিলিং এর অসাধারণ স্টাকো ভাস্কর্য মুগ্ধ করবেই।ষোড়শ শতকে তৈরি এই বিখ্যাত সিঁড়ি কেবলমাত্র মন্ত্রীমহল ও মান্যগণ্য ব্যক্তিরাই ব্যবহার করতেন। প্রাসাদের উপরাংশে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হলো গ্রান্ড কাউন্সিল চেম্বার বা দরবারকক্ষ।বিশালাকৃতি এই হলঘরে একসাথে প্রায় ২০০০ মানুষ বসার ব্যবস্থা করা যায়।সভাকক্ষের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে টিনটরেটোর আঁকা জগদ্বিখ্যাত ছবি প্যারাডিসো বা প্যারাডাইস।প্রাক্তন শাসকদের তৈলচিত্র ও রয়েছে এই ঘরেই। প্যালেসে বহু বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর হাতে আঁকা ছবি রয়েছে তারমধ্যে বেশ কিছুর নাম না নিলেই নয়।যেমন কার্পাচ্চিওর আঁকা "দি লায়ন অফ্ সেন্ট মার্ক", ভেরোনিজের 'অ্যাপোথিওসিস অফ্ ভেনিস','দি ব্লাইনডিং অফ্ হারকিউলিস',টিনটোরেটোর আঁকা 'ট্রান্সফিগারেশান অফ্ ক্রাইস্ট','প্রোটেকশান অফ দি ভার্জিন','দি ডিসকভারি অফ্ আরিয়ানা'।আমি যদিও ছবির কিছুই বুঝিনা কিন্তু এইগুলি সত্যিই সুন্দর। প্রাসাদের অস্ত্রাগারটিও দেখার মতো।অসাধারণ কিছু যুদ্ধাস্ত্রের সংগ্রহ রয়েছে এখানে।শোনা যায় ফরাসি রাজা চতুর্থ হেনরি তার বহু অস্ত্র ভেনেশিয়ান রিপাবলিক কে দান করেছিলেন,যার নিদর্শন এখনো অস্ত্রাগারে মজুত আছে।অস্ত্রশালার বিখ্যাত কিছু অস্ত্রর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'ডেভিলস্ বক্স' বা শয়তানের বাক্স্।যারমধ্যে একটি চার ব্যারেলের বন্দুক রয়েছে,উৎসুক শত্রু বাক্স খুললেই নিশ্চিত মৃত্যু।আরো রয়েছে যুদ্ধবন্দিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য পেরেকগোঁজা গলবন্ধনী,বিশালাকৃতি তরোয়াল যা মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত দোষীর মুন্ডচ্ছেদ করতে ব্যবহার হতো।এছাড়াও প্রায় ২০০০ এরও বেশী ছোট বড় মাঝারি নানা আকারের অস্ত্র সংগ্রহশালাতে মজুত আছে। প্রাসাদের অন্যতম আকর্ষণ হলো কারাগার বা প্রিজন্।অন্ধকার,সরু সরু সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছাতে হয় কারাগারে।সংকীর্ণ করিডোরে দিনের আলো একফোঁটাও প্রবেশ করেনা,নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে।এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বন্দীদশা যে খুবই কষ্টকর হতো বোঝা যায়।প্রাসাদের সঙ্গেই রয়েছে এই ওল্ড্ প্রিজন্।পরবর্তীকালে আরেকটি নিউ প্রিজন্ বানানো হয়,যেখানে বন্দীদের কথা ভেবে কারাকক্ষগুলি খানিকটা প্রশস্ত এবং স্বাস্থ্যকর বানানো হয়েছিল।এই নতুন কারাকক্ষ আর প্যালেসের মাঝে রয়েছে মনকেমন করা 'ব্রিজ অফ্ সাইস্' বা 'দীর্ঘনিঃশ্বাসের সেতু'।লর্ড বায়রন এটির নামকরন করেন। পনেরো বছরের একটি ছেলে,তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।ঘরে তার মা,ছোট বোন আছে।ছবি আঁকতো সে,পাহাড়,নদী,আকাশের।মায়ের ছবি আঁকতো।আরো কত কি আঁকতো।একদিন সে কি জানি একটা ছবি আঁকলো।সৈন্যশাস্ত্রী এসে ধরে নিয়ে গেলো তাকে।বিচার হলো কিশোর ছেলের।বিচারপতি বললেন খ্রীষ্টবিরোধী সে,বাইবেল মানেনি।এগারোজন পেয়াদা নিয়ে চললো তাকে অন্ধকুঠরির পথে।পথে পড়লো সেই সেতু।সেদিন আকাশ ছিলো গাঢ় নীল,সমুদ্রের মতো গভীর।একদন্ড দাঁড়ালো সে।সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়া তার বেপরোয়া সোনালি চুল এলোমেলো করে দিলো।পৃথিবীর আলো আর কখনও দেখা হবেনা তাঁর।ছবি আঁকা হবেনা।মায়ের সাথে দেখা হবেনা।প্রানভরে নিঃশ্বাস নিলো সে,তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো কারাকক্ষের উদ্দেশ্যে।এই ছেলেটির বা আরো ওরমতো বহুজনের হতাশার সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘনিঃশ্বাসের সেতু। আমাদের ভেনিস ভ্রমণ সেদিনের মতো এখানেই শেষ হয়েছিল।ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছিলাম ফ্লোরেন্সের উদ্দেশ্যে ।ভেনিসে আবার ফিরবো পরে। ভেনিসের জন্য বলবো - 'You can leave venice,but venice never leaves you-Venice is eternity itself'. ( Information courtesy-Internet and the leaflets I collected from doge's palace) P.S-Please forgive the wrong pronunciations of Italian names,I had a tough time translating them into bengali.

Related Articles