665
Riya Singh

মনখারাপী স্মৃতি


গল্পের নাম -মনখারাপী স্মৃতি


-:কোনোদিন কারোর কাজল লেপ্টে যাওয়া চোখের প্রেমে পড়েছো বিতান শর্মি সুদূর আকাশের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থেকে বললো।


-:নাহ,কিন্ত এক মায়াবী ছটফটে পাগলীর প্রেমে পড়েছি বলেই আলতো করে শর্মির নাকটা টিপে দিলো বিতান।


-:এই শোনো আমি মরে গেলে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে না তো ? কোমরে হাত দিয়ে রাগী রাগী মুখ করে দাঁড়িয়ে বললো শর্মি।


-:তুমি ছাড়া আমি জীবনটাকে কল্পনাও করতে পারি না শর্মী, আর প্লিস আমাকে মরার কথা বলা তো দূর নিজের ভাবনাতেও আনবে না এইসব বলে মুখ হাঁড়ি করে উঠে পড়লো বিতান।


-:এই রে বাবুর সত্যি গোঁসা হয়েছে বলেই নিজের জিভ কামড়ালো শর্মি।


-:নিজে ভালো করেই জানে এইসব কথা আমার ভালো লাগে না। তবুও বারেবারে এই বিষয়ে কথা বলবে হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনেই বকবক করছিলো বিতান।


বিতাআআআআআন,বিতাআআআআন

কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে গেল নিজের নামটা শুনে বিতান।

পিছনে ফিরে দেখলো শর্মি কোনমতে শাড়ির কুঁচিটা ধরে ওর নাম ধরে ডাকছে।উফফফ কতোক্ষন ধরে ডাকছি বলোতো।এতো রাগ কিসের হ্যাঁ? হাপাতে হাপাতে কোনরকমে শর্মি বললো।


রাগ নয়, তোমার জন্য আইসক্রিম কিনতে যাচ্ছিলাম বুঝলে মুখটা ফুলিয়েই বললো বিতান।


সেই,নাকটা ফুলছে লুচির মতো তবুও বাবু বলবেন রাগ হয়নি বলেই হা হা করে হেসে ফেললো শর্মী।


রাগালো কে শুনি! মাথায় এক চাঁটি মারবো খালি ফাজলামি চুপটি করে দাঁড়াও আমি যাবো আর আসবো বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেলো রাস্তার মোড়ে।


    দুজনের দেখা আজ থেকে তিনবছর আগে সরস্বতী পূজোর দিনেই।দুজনে যে যার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছিল।


    কিন্তু মাঝপথেই শর্মীর পিরিয়ড হয়,,, যেহেতু লাল শাড়ি ছিল বোঝা যায়নি।তাই একটু পিছিয়ে বন্ধুদের থেকে শর্মী রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে পড়ে।

      পিরিয়ড লজ্জার কোন বিষয় নয়, একটী স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া আফসোস এখনো পর্যন্ত বর্তমান সমাজে অনেক মেয়েরা প্রকাশ্যে বলতে লজ্জা পায়। হয়তো উন্নত মানসিকতা এবং চিন্তাধারাতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেনি সমাজটাই।

যাইহোক বিতান লক্ষ্য করছিল শর্মিকে। দেখছিল বারবার। মেয়েটা পিছনে শাড়ির আঁচল চাপা দিচ্ছিল। তাই বন্ধুদের এগোতে বলে নিজেই শর্মির কাছে গিয়ে। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো বিতান-:

ম্যাডাম আপনার কিছু অসুবিধা হচ্ছে। তাহলে বলুন সাহায্য লাগলে।

শর্মী আমতা-আমতা করে ছল ছল চোখে বলেছিল -:আসলে আমার না পিরিয়ডস হয়েছে। বিতান একটু হেসে আশ্বস্ত করে বলেছিল -:

হম বুঝলাম সামনে একটা লেডিস টয়লেট আছে।ওখানে চেঞ্জ করে নেবেন আপনি।আমি স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে দিচ্ছি।

এভাবেই শুরু হয়েছিলো ওদের প্রথম আলাপ। তারপরে আস্তে আস্তে হঠাৎ আরও দু-তিন বার দেখা।একে অপরকে চেনা, বন্ধুত্, ফোন নাম্বার দেওয়া নেওয়া,একে অপরকে ভালোলাগা,ভালোবাসার উপলব্ধি করা একে অপরকে ভালোবাসি সেটা জানানো।এখনতো বিতান তো ভালো চাকরি ও পেয়েছে, এদিকে শর্মি কলেজ শেষ করে নার্সের ট্রেনিং নিচ্ছে। এখন দুই বাড়িতে জানে সম্পর্কও ওদের। বিতান ভালো ছেলে বলে দুই বাড়িতে মেনেও নিয়েছে।

তবে কে জানতো এটাই শেষ সরস্বতী পুজো কাটানো দুজনে একসাথে ওদের? পুজোর কিছুদিন পর থেকেই প্রচন্ড শর্মির মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। তার সাথে চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীন হতে থাকে। মাথা যন্ত্রণা প্রায়শই হতো। কিন্তু কখনো কাউকে জানায় নি এমনকি বিতানকেও না। বেচারা কাজের চাপে অফিসে খুবই ব্যস্ত থাকে আবার দূরে থাকে সেই কারণে। বেকার জানতে পারলে অযথা মাতামাতি করবে এসব নিয়ে।


শেষ পর্যন্ত এটাই যদি বিচ্ছেদের কারণ হয়ে যায়।মাথা যন্ত্রণা অতিরিক্ত হওয়ার কারণে শর্মিকে হসপিটালে অ্যাডমিট করতে হয়। বিতানের বাড়ির লোকজনকে জানাতে বারন করে শর্মি। বিতানের কলকাতার বাইরে বদলির চাকরির জানান এই সব কিছু ব্যাপার অজানাই থাকে তার কাছে। শর্মীর যখন জানতে পারে ওর ব্রেন টিউমার লাস্ট স্টেজ খুব জোর হলে এক সপ্তাহ বাঁচবে। নিজে থেকেই বিতানের সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়।

যখন বিতান ফিরে আসে তখন সবটা শেষ ,শর্মি ততক্ষণে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে। এবং তার আদরের শর্মির ফটোতে মালা পড়ানো। এমন সময়ে শর্মির বাবা বিতানে হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলেন আমার মেয়ে তোমার জন্য রেখে গেছে তার দেওয়া তোমাকে এটাই শেষ উপহার। শর্মি মারা যাওয়ার আগে বলেছিল তোমার সব প্রশ্নের জবাব এতেই আছে। ওর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ওকে পোড়ানো হয়নি ওর প্রিয় শিউলি গাছের তলায় কবর দেয়া হয়েছে।


চিঠিটা খুলে বিতান পড়তে শুরু করলো


চিঠিতে লেখা ছিল,

প্রিয় বিতান,

তুমি যখন এসে পড়বে ততক্ষনে আমি ঐ দূর আকাশের তারা। রেগে আছো তাই না! খুব কষ্ট হচ্ছে তাইতো? স্বাভাবিক রাগ করাটা হঠাৎ করে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম যে। বিশ্বাস করো তবে তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই আমার ছিলনা। কিন্তু ভাগ্য যে বড়ই নিষ্ঠুর। তোমার থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিল। ভেবেছিলাম সারাটা জীবন তোমার পাশে থেকে তোমার সাফল্য ব্যর্থতার সাথী হবো । তোমার সবকিছু সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেব ।আর হলো কই? সবটাই নিয়তির জন্য শেষ হয়ে গেল। তোমার জন্য কনের সাজে সাজার আগেই যে ডাক এসে গেল আমার। চুপিসারে মারণরোগটা কখন যে শরীরে জাঁকিয়ে বসেছে বুঝতেই পারলাম না। জানো তুমি থাকলে খুবই আঘাত পেতে দেখতে পারতে না আমার কষ্টগুলো ।আমার সব চুল উঠে গেছে জানো, আমায় দেখতে কুৎসিত হয়ে গেছে। তাইতো তোমাকে বলিনি কিছুই। নিজেকে অপরাধী প্রমাণ করে তোমার থেকে দূরে চলে গেলাম একেবারে মত।প্লিজ কেঁদো না তোমার চোখের জল আমি সহ্য করতে পারিনা। ভেবনা দূরে সরে গেছি। চোখ বুজে অনুভব করো দেখবে তোমার পাশেই আছি। আর হয়তো আমাদের স্পর্শের যোগাযোগ থাকবে না। আত্মার যোগাযোগটা আজীবন থাকবে। চোখটা বুজে অনুভব করে দেখবে আমি কোথাও যাইনি তোমার মনেই সারা জীবন বসবাস করবো।একটাই অনুরোধ প্রতিদিন আমার প্রিয় হলুদ গোলাপ একটা শিউলি গাছের নিচে রেখো ।আমি শান্তি পাবো। নিজের খেয়াল রেখো এই পাগলটা ভালোবাসি তোমায় ,তুমি কষ্টে থাকলে যে আমারো কষ্ট হয়। শান্তিতে মরতে পারি নি তোমার সাথে শেষ দেখাটুকুও করা হলো না। তোমার অভিযোগ ছিল না আমি কোনদিন তোমাকে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলিনি। আজ বিদায় বেলায় বলতেছে বড্ড ভালোবাসি।তোমার সবটুকু নিয়ে তোমায় আমি ভালোবাসি তাইতো বলিনি তোমাকে আমার আমার রোগের কথা ।ভালো থেকো বিতান। আমি হয়তো তোমার মাঝে চিরটা কাল বেঁচে থাকব।

ইতি

তোমার আদরের শর্মি।


এই শোকটা বিতান শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে পারেনি। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবন থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়। একে একে অফিস নিজের কাজকর্ম। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে বসে থাকতো। শুনে কবরটা আঁকড়ে ধরে ওখানেই সারাদিন কাটিয়ে দিত। বিবি করে একটা কথাই বলতো আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি একটিবারও বুঝলে না তুমি আমার।একবার বলে যেতে পারতে তাহলে হয়তো এভাবে মরতে হতো না দেখো তোমার প্রিয় হলুদ গোলাপ আমি এনেছি। পছন্দ হয়েছে তো। ভালবাসি খুব তোমায়। সাথে করে নিজের নিয়ে যেও। একা যে তোমায় ছেড়ে বাঁচতে পারব না। শেষে দেখা গেল বিতান মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে। এক বদ্ধ উন্মাদ পরিণত হয়েছে সে। বর্তমানে সবাই তাকে বিনুপাগলা নামে চেনে।


"সত্যি ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়।

মারা যাওয়ার পরেও আজীবন অমর রয়ে যায়। ভালোবাসা যে অবিনশ্বর আত্মার সাথে আত্মার।

দেহের সমাপ্তি ঘটলেও ভালবাসা চিরটা কাল থেকে যায়।

কিছু মন খারাপের স্মৃতি বুঝি এমনই হয়।

কখনো বা কাঁদায় কখনও বা হাসায়।

নিজস্ব স্বাভাবিক মানসিক বোধশক্তি লোপ পায়।"


সমাপ্ত।।

Related Articles